Monday, January 10, 2011

সব বিধিনিষেধ উঠে গেল ঋণসীমা ১:২ পর্যন্ত বৃদ্ধি (এসইসির সিদ্ধান্ত)

এসইসির সিদ্ধান্তসব বিধিনিষেধ উঠে গেল ঋণসীমা ১:২ পর্যন্ত বৃদ্ধি পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)। বাজারের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে বিনিয়োগের পথে এসইসি যত ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল, গতকাল সোমবার তার সবই তুলে নেওয়া হয়েছে।
গতকাল শেয়ারের বিপরীতে ঋণসীমা বাড়ানো, স্পট মার্কেট থেকে ১৪ কম্পানিকে স্বাভাবিক লেনদেনে ফিরিয়ে আনা, ঋণসুবিধার বাইরে থাকা কম্পানির শেয়ারে আর্থিক সমন্বয় বা নেটিং-সুবিধা চালুসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয় এসইসি। আজ মঙ্গলবার থেকেই এসব সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। 
গতকাল বিকেলে এসইসির সভাকক্ষে আয়োজিত এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসব সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। এ সময় ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই-সিএসই) ও মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
শেয়ারের বিপরীতে ঋণসীমা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও। গতকালই বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আজ থেকে ঋণসীমা বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মার্চেন্ট ব্যাংকার্সদের সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনও (বিএমবিএ) ঋণসীমা বাড়ানোর জন্য তাদের সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় বিএমবিএর এক জরুরি সভা থেকে এ আহ্বান জানানো হয়।
এদিকে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসইসিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশা প্রকাশ করেন, এসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের ইতিবাচক বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে শেয়ারবাজারে আবারও স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত না হওয়ারও আহ্বান জানানো হয়।
শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এসইসি যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে গ্রাহকের ঋণসীমা ১ঃ২ নির্ধারণ। এর ফলে কোনো বিনিয়োগকারী নিজে এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে তার বিপরীতে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণসুবিধা পাবেন। তবে কোন প্রতিষ্ঠান কী হারে ঋণ বিতরণ করবে, সেটি নির্ভর করছে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব সিদ্ধান্তের ওপর।
ঋণসীমা বাড়ানোর পাশাপাশি স্পট মার্কেট নামের নগদ টাকার মার্কেটে থাকা ১৪ কম্পানিকে মূল বাজারে ফিরিয়ে আনা হবে। দাম বাড়ার লাগাম টানতে গত ৫ ডিসেম্বর এসব কম্পানিকে স্পট মার্কেটে স্থানান্তর করা হয়। এ ছাড়া ঋণের বাইরে থাকা কম্পানির (নন-মার্জিন) ক্ষেত্রে আর্থিক সমন্বয়সুবিধা চালু করা হয়।
গতকাল মার্চেন্ট ব্যাংকের বিনিয়োগক্ষমতার ওপর থেকেও বিধিনিষেধ তুলে নিয়েছে এসইসি।
আগে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো আন্ডাররাইটার ও পোর্টফোলিওতে তার পরিশোধিত মূলধনের পাঁচ গুণের বেশি বিনিয়োগ করতে পারত না। কিন্তু আজ থেকে সে ধরনের কোনো সীমা থাকছে না।
এসইসির এসব সিদ্ধান্তের পাশাপাশি পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতার স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংকও বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পুঁজিবাজারের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট এ রকম সিদ্ধান্ত পরিপালনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্পৃক্ত থাকার ঘোষণা দিয়েছে।
গতকাল শেয়ারবাজারে দরপতনকে ঘিরে দেশজুড়ে যে অস্থির অবস্থা তৈরি হয়, তারই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ওপর মহলের নির্দেশে দুই নিয়ন্ত্রক দফায় দফায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে গতকাল জরুরি বৈঠকে বসে। এসব বৈঠকের পর দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
এর আগে এসইসি সকাল থেকে দুই স্টক এক্সচেঞ্জ ও মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করে। ওই বৈঠকের পর নিজেরা ফের বৈঠকে বসে। একই সঙ্গে টেলিফোনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সরকারের বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে এসইসির চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকার বলেন, তারল্য সংকটের কারণেই শেয়ারবাজারে আজকের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি গোলাম মোর্তুজা আহমেদ বলেন, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে ঋণসুবিধা দিয়ে থাকে, তার বেশির ভাগই আসে ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকগুলো একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে তার পরিশোধিত মূলধনের ১৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিতে পারে না। এ নিয়মের কারণে বেশির ভাগ মার্চেন্ট ব্যাংক মূল প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে চাহিদামাফিক ঋণসুবিধা পাচ্ছে না। তাই ব্যাংকিং চ্যানেলে অতিরিক্ত তারল্য থাকলেও এর কোনো সুফল পুঁজিবাজারে মিলছে না।
সংবাদ সম্মেলনে এসইসি আরো জানিয়েছে, দরপতনের কারণে কোনো বিনিয়োগকারীর ঋণে কেনা শেয়ার জোরপূবর্ক বিক্রির (ফোর্স সেল) আওতায় পড়লেও এ ক্ষেত্রে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো নমনীয় থাকবে।
ডিএসই সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, শেয়ারবাজারে দাম কমলে আবার দাম বাড়বে। তাই বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারানোর কিছু নেই।
সিএসই সভাপতি ফখরুদ্দিন বিনিয়োগকারীদের ভীত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, দেশের অর্থনীতিতে এমন কোনো খারাপ খবর বা ঘটনা ঘটেনি যাতে পুঁজিবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা ভীত হয়ে শেয়ার বিক্রি করবেন না। এতে নিজেরা ক্ষতির মুখে পড়বেন। বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী যদি ভীত হয়ে শেয়ার বিক্রি না করেন তাহলে বাজারে বড় ধরনের কোনো দরপতন ঘটবে না।’
সংবাদ সম্মেলনে এসইসির চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকার, সদস্য মনসুর আলম ও ইয়াছিন আলী, ডিএসইর সভাপতি শাকিল রিজভী, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি নাসিরউদ্দিন চৌধুরী, প্রধান নির্বাহী সতিপতি মৈত্র, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সভাপতি ফখরুদ্দিন আলী আহমেদ, সহসভাপতি আল মারুফ খান, মার্চেন্ট ব্যাংকার্স প্রতিনিধি গোলাম মোর্তুজা আহমেদ ছাড়া দুই স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তা, এসইসি নির্বাহী পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন।
বিএমবিএর সিদ্ধান্ত : বিএমবিএর গতকালের বৈঠকে শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা ফেরাতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় প্রতিটি মার্চেন্ট ব্যাংককে আগামীকাল থেকে নিজ নিজ সাধ্যের সর্বোচ্চ সীমা ব্যবহার করে ঋণ বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আÍবিশ্বাস ফেরানোর উদ্যোগ গ্রহণেরও আহ্বান জানানো হয়।
একই সঙ্গে গতকালে সভায় বিএমবিএ নতুন সভাপতি মনোনীত হন প্রাইম ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী গোলাম মোর্তুজা আহমেদ। তিনি আরিফ খানের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন।
গোলাম মোর্তুজা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা প্রতিটি মার্চেন্ট ব্যাংককে ঋণসীমা বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছি। প্রতিটি মার্চেন্ট ব্যাংক যেন ঋণ বাড়ানোর ক্ষেত্রে তাদের সাধ্যমতো সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা নেয়, সেই আহ্বানও জানিয়েছি। আশা করছি, সব মার্চেন্ট ব্যাংক এ আহ্বানে সাড়া দেবে।’
জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশও (আইসিবি) আজ থেকে গ্রাহকদের সর্বোচ্চ ঋণ সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, এসইসির সিদ্ধান্ত যথাযথ পরিপালনে আইসিবি সব সময় প্রস্তুত।
বেসরকারি বেশ কয়েকটি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানও আজ থেকে ঋণসীমা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তবে কী পরিমাণ ঋণসুবিধা প্রতিষ্ঠানগুলো বাড়াতে পারবে, গত রাত পর্যন্ত তা নিশ্চিত করা যায়নি।
গতকাল পর্যন্ত ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এসইসির বেঁধে দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী বিনিয়োগকারীদের সর্বোচ্চ ১ঃ১.৫ হারে ঋণসুবিধা দিতে পারত। কিন্তু তারল্য সংকটের কারণে বেশির ভাগ ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানই গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সীমার ঋণ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। হাতে গোনা কয়েকটি মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউস ছাড়া কেউই গ্রাহকদের ১ঃ১ হারের বেশি ঋণ দিতে পারেনি।

No comments:

Post a Comment

Total Pageviews